স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই সেচ কার্যক্রমে সরকার যথেষ্ট সহায়তা দিচ্ছে। অবকাঠামো উন্নয়ন ও নীতি সহায়তার পাশাপাশি কৃষককে সরাসরি সহায়তা করা হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) সেচ নিয়ে কাজ করছে। উত্তরাঞ্চলের বরেন্দ্র অঞ্চলে অবকাঠামো সরকার তৈরি করে দিয়েছে। এর পর পানি ব্যবস্থাপনা সোসাইটির ওপর ছেড়ে দিয়েছে, এটা খুব ভালো ব্যবস্থা। এটার পুনরাবৃত্তি ঘটলে ভালো হবে। এ পদ্ধতিটাকে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) বলা যেতে পারে। পুকুর করা, পানি আটকে রাখা, নদীতে বাঁধ দেয়ার কাজ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিতে পারে বা উপজেলা-ইউনিয়ন পরিষদকে দায়িত্ব দিতে পারে। যেভাবে অবকাঠামো উন্নয়ন হচ্ছে, তা আরো ব্যাপক আকারে করে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে পারে। তাহলে আমার মনে হয়, সেচের ক্ষেত্রে আর কোনো সাবসিডি লাগবে না।
তবে সেচ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ কিংবা উন্নত বিশ্বের প্রযুক্তি আমাদের দেশে খুব একটা প্রচলন ঘটেনি। যেগুলো আছে, সেগুলো ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতি, যেমন— ডিপ বা শ্যালো টিউবওয়েল। সেচ প্রযুক্তিতে আমরা পিছিয়ে আছি, যেমন— ড্রিপ ইরিগেশন, ওয়াটার পাঞ্চ করে ভূগর্ভে ঠেলে দেয়া, তার কোনো কিছুই আমাদের দেশে নেই। তবে সারফেস থেকে পানি তুলে পাইপের মাধ্যমে দেয়ার যে প্রচলন শুরু হয়েছে, তা ভালো। এ ব্যবস্থা তেমন আধুনিক না হলেও খারাপ না। প্রচলিত পদ্ধতি থেকে বের হয়ে এসে ভূ-উপরিস্থ পানি মাটির নিচে সংরক্ষণের সময় এসে গেছে। আর এ ধরনের প্রযুক্তি সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চালু হলেও বাংলাদেশে তা হয়নি। প্রকল্পভাবে কিছু এলাকায় দেখানোর চেষ্টা চলছে, সেটি সম্প্রসারণ করতে হবে দ্রুতবেগে।
মরুভূমির মতো পানি নেই, তা কিন্তু নয়। পানি আছে, তবে তা ধরে রাখতে পারি না। তাই পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। রাতারাতি ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন বন্ধ করে দেয়া হলে কৃষক এ পানি দিয়ে সেচ দিতে পারবে না। এটা হলে তা সবার জন্যই খুবই কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। এখন আমাদের দেখা দরকার কী কীভাবে পানি ধরা সম্ভব। কেননা পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি বিভিন্ন নদ-নদী হয়ে আসে, আবার প্রচুর বৃষ্টিও হয়। এর বড় অংশ সমুদ্রে চলে যায়, যা লোনা হয়ে যাওয়ায় ব্যবহার করা যায় না।
নদী-নালা হয়ে যে পানি আসে, তা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ধরে রাখা যায়। তাহলে সুবিধা হবে— ওই অঞ্চলে যতটুকু পানি মানুষের ব্যবহারের দরকার হয়, সেটা সেখান থেকে পাওয়া যাবে। উপরিভাগে পানি আটকানো থাকলে ভূগর্ভের পানির স্তর উপরে উঠে আসবে। আবার ধরে রাখা পানি ব্যবহার করে চাষবাস করা যাবে। ফসল চাষের ফলে পানি কমে গেছে, তা কিন্তু নয়। পানি কমে গেছে, কারণ পানি থাকছে না, চলে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের সুযোগ আছে পানি ধরে রাখার। সরকারও এটা করতে পারে। আগেও করেছে। আমরা দেখেছি মহানন্দা থেকে পানি তুলে পাইপ দিয়ে সরবরাহ করা হচ্ছে। এটা ভালো উদ্যোগ। আগের প্রকল্পগুলোয় ব্যবস্থাপনায় সমস্যা ছিল, পানিবণ্টনেও সমস্যা ছিল। বড় বড় খালের মাধ্যমে মাটির উপরিভাগের পানি ছেড়ে দেয়া হতো। এখন যেটা করা হচ্ছে— পানি তুলে খালে দেয়া হচ্ছে না, পাইপ দিয়ে বিভিন্ন পয়েন্টে সরবরাহ করা হচ্ছে, তা বিনামূল্যে নয়। এখন মানুষ কিন্তু পানির মূল্যটা বোঝে। তবে যে দাম নেয়া হচ্ছে, তা নিতান্তই কম। কৃষকের জন্য খুবই লাভজনক। পয়সা দিয়েও কিন্তু ভালো পানি পাচ্ছে।
তবে নিচ থেকে পানি তোলা বন্ধ করার মতো কিছু করতে হবে। যেখানে পানি তোলা দরকার, সেখানে তুলবে। আর যেখানে পানি দেয়া দরকার, সেখানে খাল থেকে পানি দেবে। সরকারের অধীনে খাস হিসেবে অনেক পুকুর আছ। এগুলোকে মাছ চাষের জন্য লিজ দেয়ার দরকার নেই। মত্স্য খাতে উৎপাদনশীলতা উন্নত হওয়ার কারণে যে হারে মাছ চাষ হচ্ছে, তা থেকে পর্যাপ্ত মাছ পাওয়া যাবে। তাহলে আমাদের মূলত নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজ ও সেচের জন্য পানি লাগবে। তাই আমাদের সরকারি যেসব জলাশয় আছে, সেগুলো সংরক্ষণ করা উচিত। দরকার হলে বিভিন্ন জলাধার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে লিজ দেয়া হবে, তবে শর্ত থাকবে যে ইকোলজিক্যালি অ্যাকসেপ্টেবল এমনভাবে বাঁধ দেয়া হবে। এতে অপচয় কমবে, ব্যবস্থাপনাও ভালো হবে। সবমিলে ভালো পানি ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে যাবে। ভারতে কিন্তু এটা করা হয়েছে। জলগাঁওয়ে একটি নদী আছে, যেটা বছরের একটা সময়ে শুকিয়ে যেত, আবার বর্ষার সময়ে পানিতে ভরে যেত। একটা সময় জেইন ইরিগেশনকে ওই নদীতে বাঁধ করতে দেয়া হলো।
তারা এসব প্রকল্পের জন্য ওই নদী থেকে পানি একটা নির্দিষ্ট মূল্য দিয়ে কিনে নেয়। আবার কৃষকও বিনামূল্যে পানি পায়। এটা এখন মডেল। একই মডেলে আমাদের দেশেও করা যেতে পারে। যেখানে বাঁধ দেয়া প্রয়োজন, সেখানকার স্থানীয় কোনো প্রতিষ্ঠানকে বাঁধ করতে দিতে হবে, যেন কোনো বিবাদ দেখা না দেয়। অথবা ইউনিয়ন পরিষদ বা উপজেলা পরিষদকে বলা হবে, তোমরা ইকোলজিক্যালি বাঁধ দিয়ে পানি আটকাতে পারবে। এখান থেকে যে পানি দেয়া হবে, তার জন্য মূল্য নেয়া হবে। এ থেকে যে অর্থ পাওয়া যাবে, তা অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হবে। যেখানে খাল-বিলের সংখ্যা কম, সেখানে আধার তৈরি করে বৃষ্টির পানি মাটির নিচে পাঠানো যায়। এতে আধারের (পুকুরের) পানি দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজ করা যাবে, পানি প্রবেশের কারণে পানির স্তর উপরে উঠে আসবে। যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ নেই, সেখানে পাম্পের সঙ্গে সোলার প্যানেলের সংযোগ দিতে হবে। এতে খরচও অনেক কমে যাবে। এটা হলো যেসব এলাকায় পানি থাকে না, বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলের জন্য। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সমস্যা হলো লোনা পানি। এসব এলাকায় বৃষ্টির পানি ধরে রাখা ছাড়া তো উপায় নেই। এক্ষেত্রে পুকুরের মতো বড় বড় আধার বানিয়ে পানি আটকাতে হবে। এ পানি মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করবে আবার ড্রিপ ইরিগেশনের মাধ্যমে ফসল চাষ করা যাবে।
আরেকটা সমস্যা হলো যখন বেশি পানি থাকে। অনেক বিলে পানি জমে থাকে। এ পানিকেও অর্থনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। আমরা সাধারণত পানি থাকলে ধান বা ফসল উৎপাদন করতে চাই। এ জমিতে ধানের বদলে মাছ চাষ করলে আরো বেশি লাভ হবে। উত্তরবঙ্গে উঁচু জমি কেটে পুকুর বানিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। এটার তো দরকার নেই। মাছ-ধান দুটোই দরকার। সিলেটে যেমন পানি সব ভাসিয়ে নিল। এতে ফসলও গেল, মাছও গেল। ধরুন বাড়ির আশপাশে যে ছোট ছোট জলাশয় আছে, যেমন— পুকুর, তাতে আমরা পোনা ছেড়ে দিলাম। পোনাটা বড় হলে এক-দুই মাস পর সেখান থেকে তুলে খাঁচার মধ্যে পুরে বিলে নামিয়ে দিলাম। যেহেতু মাছ খাঁচায় আটকানো, এতে বিলের পানি বাড়লেও কিছু যায় আসে না। যেহেতু বাজারে ফিশ ফিড পাওয়া যায়, তাই মাছের খাবার নিয়েও সমস্যা হবে না। এতে মাছ প্রচুর অক্সিজেন পাবে, পানি পাবে, খাবার পাবে। দেখা যাবে মাছের স্বাদও বেড়ে গেছে। তখন আর কেউ বাজারে গিয়ে নদীর মাছ আলাদা করে খুঁজবে না। এভাবে জলাভূমিগুলোকে ইকোনমিক মাল্টিপ্লাইয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। তবে এটা শুধু বিলে না, নদীর পাড়ে-মোহনায় যেখানে বড় জলাভূমি আছে, সেখানেও করা যাবে।
বরেন্দ্রতে আগে থেকে ফসল হতো, এখনো সেটা আছে। এর পর প্রচুর পরিমাণ সবজি ও ফল পাওয়া গেছে। এখন দেখা যাচ্ছে, এ এলাকায় প্রচুর শিল্প-কারখানা হচ্ছে। এ ট্রেন্ড কিন্তু থামানো যাবে না। গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের (জিকে প্রজেক্ট) মতো উদ্যোগে সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে আরো বেশি সুফল পাওয়া যাবে। ঢালাওভাবে পানি না দিয়ে সমিতি গঠন করে পানিবণ্টন করা যেতে পারে। এ সমিতি পানিবণ্টন, এর বিপরীতে অর্থ আদায় থেকে শুরু করে বাকি সব কাজ করবে। এতে পানির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত হবে।
ইদানীংকালে দেখা যাচ্ছে, পানির অপচয় রোধ করার জন্য ক্ষেতে পানি পরিমাপ করার উপায় বেরিয়েছে। পানি দেয়ার সময়ও নির্ধারণ করা যাচ্ছে। এসব পদ্ধতিকে আরো সম্প্রসারণ করে কাজে লাগানো যেতে পারে। যেমন— ধানের জীবনকাল কয়েকটি ভাগে বিভক্ত। ট্রান্সপ্লান্টেশন বা ধান লাগানো, গ্রোয়িং বা বৃদ্ধিকাল ইত্যাদি। ধান যখন লাগানো হয়, তখন পানি আটকে রাখতে হয়, যেন ঘাস জন্মাতে না পারে। এর পর পানি ছেড়ে দিতে হয়, ২০ থেকে ২৫ দিন পর্যন্ত। তার মানে এ সময় পানি লাগছে না। এ সময় কেউ না বুঝে সেচ দিলে ফসলও হবে না আবার পানিও নষ্ট হবে। শীষ চলে এলে পানি আটকাতে হবে এবং মোটামুটি থাকলে হয়। এ ব্যাপারে কৃষককে সচেতন করা গেলে পানির অপচয় অনেক কমানো যাবে। সেচের জন্য যেসব ক্যানেল বা নালা রয়েছে, সেগুলোকে পাইপ দিয়ে মাটির নিচে স্থাপন করা যায়। এতে পানি বাষ্পীভূত হবে না, আটকাবে না, গড়িয়ে যাবে না, যার ফলে ফ্লাড ইরিগেশনের প্রয়োজন হবে না। এতে পানির ব্যবহার অর্ধেক পর্যন্ত কমানো সম্ভব।
পানির সঠিক ব্যবহারে ক্রপ প্যাটার্ন পরিবর্তন করা যেতে পারে। দেশের অনেক অঞ্চলে এরই মধ্যে এটা শুরু হয়ে গেছে। যেমন— যেসব এলাকায় পানির খুব সমস্যা, সেসব এলাকায় ফসলের বদলে দেশী-বিদেশী ফলের বাগান হচ্ছে। বাজারে এসব ফলের চাহিদাও কিন্তু আছে। যেমন ড্রাগন ফ্রুট, আমড়া, থাই পেয়ারা এখন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। ফলে পানি অনেক কম লাগে। আবার চাষপদ্ধতিও পরিবর্তন করা যায়। যেমন— ইরিগেটেড রাইসের বদলে ব্রডকাস্টেড রাইস (ডিরেক্ট সিডিং) করা দরকার। ভিয়েতনামে ব্রডকাস্টেড পদ্ধতিতে চাষের মাধ্যমে ৮৫ দিনে দেড় ফুট উচ্চতার গাছ থেকে ছয় টন ফলন পাওয়া যায়, আর আমাদের দেশে প্রচলিত পদ্ধতিতে আবাদকৃত দুই ফুটের ধান গাছ ১৫০ দিনে গড়ে চার টন ফলন দেয়। তার পর যে বিষয়ে নজর দেয়া উচিত, সেটা হলো ভ্যারাইটি। যেমন ব্রডকাস্টেড রাইস করতে গেলে গাছের শিকড় লম্বা হতে হবে, নয়তো পানি পাবে না। তাই এমন জাত লাগবে, যার শিকড় লম্বা হয়। এতে আমরা কম পানিতে অনেক বেশি ফলন পাব। এ পদ্ধতিতে ধান ছাড়াও গম, ভুট্টা, তেলবীজ, সবজি চাষ করা যেতে পারে।
ক্রপ জোনিং করা যেতে পারে। এটা এখন খুব দরকার। এর মানে এই না যে, ওই এলাকায় অন্য ফসল চাষ করা যাবে না। যাবে, তবে একটা ফসল প্রায়োরিটি পাবে, যেটাকে ক্রমাগতভাবে প্রমোট করা হবে। যারা প্রমোট করবে, তাদের ট্রেনিং দেয়া হবে। কৃষককে ফসলের অর্থনৈতিক গুরুত্ব, বিপণন, সংরক্ষণ, ভ্যারাইটির ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। এভাবে ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পানি অপচয় রোধ করা যাবে।